ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে ইসলাম কি বলে? করোনাভাইরাস বনাম ইসলাম।

ছোঁয়াচে রোগ ইসলাম, ইসলামে ছোঁয়াচে রোগ বলে কিছু নেই, ছোঁয়াচে রোগ ইসলাম কি বলে, ছোঁয়াচে রোগ হাদিস, ইসলামে ছোঁয়াচে রোগ আছে কি, ইসলামে ছোঁয়াচে রোগ, ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে হাদিস, করোনা ভাইরাস, করোনা ভাইরাস ২০২১

নিঃসন্দেহে একুশ শতকের সবচেয়ে বড় আতঙ্কেরবনাম 'নোভেল করোনাভাইরাস '। সামাণ্য এই অণুজীবটির কাছে সারাবিশ্ব আজ অসহায়। মৃত্যুপুরীতে পরিণত হচ্ছে দেশের পর দেশ। লকডাউন করা হচ্ছে নগরের পর নগর, রাষ্ট্রের পর রাষ্ট্র, বা বলতে গেলে সারাবিশ্বই। আমাদের দেশেও লকডাউন চলছে। মিডিয়ায় এখন এই একটিই আলোচনা - 'করোনাভাইরাস'। দেশের মানুষকে সচেতন করছে প্রশাসন। প্রশাসনিকভাবে মসজিদে মসজিদে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে সতর্কতার। সব ধরনের গণজমায়েত করা হচ্ছে নিষিদ্ধ। এমনকি মসজিদে গমনেও এখন সতর্ক করা হচ্ছে। এমন জটিল পরিস্থিতিতে অনেক সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানগন মুখিয়ে থাকে তার মহল্লার ইমামের দিকে, আলেমদের দিকে।

সাপ্তাহিক জুমু'আর দিনে মসজিদে বয়ান হয়। চলমান করোনাভাইরাস নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। অনেকানেক মসজিদে বলা হচ্ছে, ইসলামে কোন ছোঁয়াচে রোগ নেই। তাই এই ভাইরাস ছোঁয়াচে ইহা বিশ্বাস করা যাবেনা। ওয়াজ-মাহফিল বন্ধের তীব্র নিন্দা জানানো হচ্ছে। মসজিদে সতর্কতার জন্য বলায় নিন্দা চলছে দেদারসে। এগুলো নাকি ইসলাম বিদ্বেষীদের ষড়যন্ত্র!

এগুলো সবই হচ্ছে ধর্মীয় আবেগ দিয়ে। বিষয়টি এমনভাবে দাঁড়িয়েছে, যেন করোনা ভাইরাস থেকে সতর্কতার জন্য মানুষকে বলতে গেলেই প্রমান হয়ে যাবে তার ইসলামে কোন বিশ্বাস নেই। এটাকে ছোঁয়াচে বললে প্রমান হয়ে যাবে তার ঈমানের ছিটেফোটাও নেই। যেই সাধারণ মানুষটিকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে কিছুটা হলেও সতর্ক করা হয়, কিন্তু এসব বক্তৃতায় সব ফানুস হয়ে যায়। বিশেষ করে ইমামদের কথা আম-মুসলমানগন ওহীজ্ঞান করে। 
অথচ, এসব বাস্তববিমুখ কথা আসলে ধর্মকে পঙ্গু হিসেবে দাঁড় করায়। যারা এসব বিষয়ের বাস্তবিক জ্ঞান রাখেন, তাদের অন্তরে তখন ধর্ম নিয়ে সন্দেহের তীর বিদ্ধ হয়। বিধর্মীদের কাছে ধর্মটা তখন আরও হাসির খোরাকে পরিণত হয়।

ছোঁয়াচে রোগ ইসলামে যারা নেই বলে তারাও জানে যে আমাদের চারিপাশে জীবাণু আছে, ভাইরাস আছে। এগুলো চর্মচোখে দেখা যায় না। মাইক্রোস্কোপ লাগিয়ে দেখতে হয়। এইগুলো আমাদের প্রাকৃতিরই অংশ। আমাদের দেশে ডেঙ্গুরোগের প্রবলেম। এটা কেন হয়? এক প্রকার জীবানুর আক্রমনের ফলেই তো। যেই জীবানু প্রধানত এডিস মশা বহন করে। তাই আমরা ডেঙ্গু থেকে হেফাজত থাকতে মশার উৎপাদন রোধের পদক্ষেপ নেই। তাছাড়া আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষপ্রনালীতেও হাজার হাজার জীবাণু আছে যেগুলো পজিটিব জীবানু - রোগপ্রতিরোধ করে। অন্যান্য প্রাণী হাঁস, মুরগী, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদির মধ্যেও জীবানু আছে। এসব জীবাণু মানুষের ভিতরে গেলে নানান রোগের সৃষ্টি করে। এসমস্ত জীবাণু একটি দেহ-সম্পন্ন জীব। সে মুরগ, হাঁস,বিড়াল,বাদুড়, কুকুরের দেহে থেকে মানুষের মধ্যেও ছড়ায়। এগুলো ভিবিন্ন জায়গায় অবস্থান নিতে পারে। তার অর্থ দাঁড়ায়, এই ভাইরাসজনিত রোগ অবশ্যই ছড়ায়।

যারা বলছে ছোঁয়াচে রোগ বলতে ইসলামে কিছু নেই,
সেই তারাই আবার প্রচার করছে ভাইরাসটি চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়েছে। সেই শহর হতে এই প্রানঘাতী ভাইরাস ২০০ শত দেশে আক্রমন করেছে। বৈশ্বিক মহামারী সৃষ্টি হয়েছে। বুঝে হোক বা না বুঝেই হোক ইহা ছোঁয়াচেই বলে বেড়াচ্ছে।
আবার যখন বলে ইসলামে ছোঁয়াচে রোগ নেই, তখন কিন্তু ইসলামকেই বাস্তবতার বিপরীতে দাঁড় করে দেয়।
অথচ, যেই হাদীস থেকে তারা দলীল দেয় তার ব্যাখা বিতর্কিত। 

সাহাবাদের যুগে তাদের অনেক কাহিনী এবং কিছু হাদীস দ্বারাও প্রতীয়মান হয় যে ছোঁয়াচে  রোগ ইসলাম শুধু স্বীকারই করে না, বরং সতর্কও করেঃ
  • আবূ সালমা ইবনু আব্দুর রহমান ইবনু আউফ রাঃ হতে বর্নিত, রাসুলুল্লাহ সঃ বলেছেন অসুস্ত উটপালের মালিক সুস্থ উঠপালের মালিকের (উঠের) কাছে আনবেনা। [মুসলিম-২২২১,৫৫৯৭]


মহামারি ছড়িয়ে পড়া এলাকায় প্রবেশ করতে বা উক্ত এলাকা থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে ঃ

  • হযরত সা’দ বি আবী ওয়াক্কাস রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যখন প্লেগ রোগ কোন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, আর তুমি উক্ত এলাকায় না থাকো, তাহলে সেই এলাকায় প্রবেশ করো না। আর যে এলাকায় তা ছড়ায় তুমি যদি উক্ত এলাকায় থাকো, তাহলে সেখান থেকে বের হয়ো না। [মুসনাদে আহমাদ- ২১৮২৭, মুসনাদুল বাজ্জার -১১৯৬, তাহাবী শরীফ -৭০৪০]


সংক্রামক রোগীকে জনসমাগমে না আসতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সতর্কতাঃ

  • আমর ইবনু শারীদ (রহঃ) সুত্রে তার পিতা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাকীফ গোত্রীয় প্রতিনিধি দলের মাঝে একজন কুষ্ঠ রোগী ছিলেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে (সংবাদ) পাঠালেন যে, আমরা তোমাকে বায়আত করে নিয়েছি। তুমি ফিরে যাও। [সহীহ মুসলিম -২২৩১, ৫৬২৮]


ইসলাম এতো কঠিন নয়। 

অনেক সময় আমরা নিজেরাই সহজ সরল বিধানকেও কঠিন করে ফেলি। যেমন ধরেন একজন ক্ষুধার্ত ব্যাক্তির নিকট যদি খাদ্যের ব্যবস্থা না থাকে। তখন কোন হারাম প্রানী দ্বারা যদি জীবন বাঁচানো যায় তখন তা বক্ষন করা শুধু জায়েজই নয়, বরং জরুরী। 
বর্তমান করোনাভাইরাসের মহামারিতে আপনি ঘরেই নামাজ পড়ুন। ইসলাম এতে আপনাকে বাধাগ্রস্ত করেনা। অনেক সাধারণ মুসলমান মনে করে পুরুষদের কেবল মসজিদেই নামাজ পড়তে হয়। যা ভ্রান্ত ধারনা। এজন্য তারা মনে করে, 'করোনাভাইরাসের কারনে কি নামাজ ত্যাগ করবো?' 
নামাজ পড়া ফরজ। কিন্তু মসজিদে জামাতে নামাজ পড়া সুন্নতে মুয়াক্বাদা। অনেকে সুন্নতে মুআক্বাদাকেই ওয়াজিবের সাথে তুলনা করেন। সেই জামাত কিন্তু আপনার বাড়িতেও করতে পারেন। হ্যা, মসজিদে ফযিলত বেশি। 
তবে ওজর হলে কি জামাত ত্যাগ করা শরীয়ত সম্মত নয়? হুজুর সঃ ত্যাগ করেন নি?
  • নাফি‘ (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রচন্ড এক শীতের রাতে ইবনু ‘উমার (রাযি.) যাজনান নামক স্থানে আযান দিলেন। অতঃপর তিনি ঘোষণা করলেনঃ তোমরা আবাস স্থলেই সালাত আদায় করে নাও। পরে তিনি আমাদের জানালেন যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরের অবস্থায় বৃষ্টি অথবা তীব্র শীতের রাতে মুয়ায্যিনকে আযান দিতে বললেন এবং সাথে সাথে এ কথাও ঘোষণা করতে বললেন যে, তোমরা নিজ বাসস্থলে সালাত আদায় কর। [সহীহ বুখারী -৬৩২,  সহীহ মুসলিম -৬৯৭]
দেখা যাচ্ছে মসজিদগুলোয় পুর্বের থেকে মুসল্লি আরো বেশি হচ্ছে। যে জীবনে নামাজ কি বুঝেনি সেও নামাজে আসছে।কারন হল, ভাইরাসে তাদের বিশ্বাস নেই। জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে তাহলে ভাইরাসকে খামোখা তারা কেন ভয় পাবো? ইহা তাদের কাছে ঈমান বিধ্বংসী কথা। ঈমানের জোশ দেখানোর উপযুক্ত একটা সময় তারা পেয়েছে। ইহাকে হাতছাড়া করা যাবেনা।

ইরানে করোনাভাইরাসের প্রকোপঃ

যেই ঈমানের জোশ দেখিয়েছিল ইরানের কোম শহরে। কোম শহরটি দেশের উচ্চ সারির ইসলামিক স্কলাদের জন্য তীর্থস্থান। ফার্সীবর্ষের প্রথম দিনকে তারা নওরোজ নামে পালন করে। প্রায় ২ কোটি ঘরোয়া এবং ২৫ লাখ আন্তর্জাতিক পর্যটক আসেন। এখানে অনেক ধর্মীয় স্থান আছে যেখানে ধার্মিকেরা সম্মান দেখানোর জন্য চুমু খায় এবং স্পর্ষ করে । যখন শহরটিতে অল্পমাত্রায় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ল, তখন শহরটিতে কোয়ারেন্টাইনের ব্যাবস্থা না নিয়ে সেখানকার গুরুরা আরো বেশি মানুষকে আমন্ত্রন করল। বলা হল, মানুষের সুস্থ হওয়ার জন্য নাকি এটি আরো উত্তম জায়গা। শারীরিক ও মনের রোগ দুর করার জন্য আরো বেশি মানুষের আসা উচিত। ফলাফল কি হল? 
১৬ দিনের মাথায় ইরানের ৩১টি প্রদেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ল। ১৬টি দেশ দাবী করছে তাদের দেশে ইরান থেকে ভাইরাস ছড়িয়েছে। ইরান হতে আসা তীর্থযাত্রীদের মধ্যে সন্দেহজনক করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা করে নিজেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন পাকিস্তানি যুবক ড. উসামা রিয়াজ। 
ইরানের দুজন সাংসদের মৃত্যু হলো। মৃত্যুপুরীতে পরিণত হলো দেশ।অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হতে লাগল । করোনাভাইরাসকে তুচ্ছজ্ঞান করে দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবন-যাপনের পরামর্শদাতা সেই ইরান সরকার তখন করোনায় আক্রান্ত রোগী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। 

আপনার ঈমানের জোশে হয়তো আপনি মসজিদে যাচ্ছেন। আক্রান্ত হলে আপনিই হবেন। কিন্তু বিষয়টিতো আর এমন নয়। আপনি আক্রান্ত হলে আপনার থেকে আপনার পরিবার আক্রান্ত হবে। আক্রান্ত হবে আপনার সমাজ। 
আমার কাছে মনে হয়েছে, সরকার এখনো পর্যন্ত মসজিদে গমন নিষেধ না দেয়ার কারন, এ দেশের পাবলিক গুলো সরকারকে ইসলামের বিরুদ্ধে কাঠগড়ায় দাঁড় করে দিবে। এই ইস্যু নিয়ে সারাদেশে আন্দোলন তৈরী করে দিবে। এর ফলে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রন ব্যাতিরেখে আন্দোলন নিয়ন্ত্রনে আগে ঝুকতে হবে। তাই ইসলামী ফাউন্ডেশনের উপর বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছে। তারা আলেমদের নিয়ে সতর্কতাকে সামনে রেখে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমরা যেন তা-ই পালন করি।

আসুন, আমরা এখন থেকে সতর্ক হই। মানুষকে এই করোনাভাইরাস সম্পর্কে বুঝানোর চেষ্টা করি এবং সতর্ক করি। নিজে সতর্ক হোন, পরিবারকে হেফাজত করুন এবং সমাজকে হেফাজত করুন। এই বৈশ্বিক মহামারী দূরীকরণে অংশীদার হোন

লেখকঃ   সাইদুর রহমান মানিক

আপনার মন্তব্য জানান

নবীনতর পূর্বতন