সতীদাহ প্রথা কী? |
সতীদাহ
সতীদাহ প্রথা হলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিধবা নারীদের স্বামীর সাথে চিতায় সহমৃত্যু বা আত্মবলি দেবার এক ঐতিহাসিক প্রথা। রাজা রামমোহন রায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে সতীদাহ প্রথা নিষ্পত্তি লাভ করে। মূলত উত্তরে এবং আধুনিক যুগের প্রারম্ভিক সময়ে পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে এই প্রথা পালিত হতে দেখা যেত। তবে ঠিক কোন সময় থেকে এই প্রথার সূচনা হয় তা নিয়ে তেমন কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় নি৷
পৌরানিক ও মধ্যযুগীয় আদর্শ
প্রাচীন সময়ে স্বত:প্রণোদিত হয়েই পতির মৃত্যুশোকে পত্নী আগুনের মধ্যে ঝাপ দিয়ে আত্ববলি দিত। পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যে এই আত্মাবিসর্জনকে অতিমাত্রায় শোকের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা হত। মহাভারত অনুসারে পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী 'মাদ্রী' সহমৃত্যুতে যান। কারণ 'মাদ্রী' পান্ডুর মৃত্যুর জন্য নিজেক দায়ী ভেবেছিলেন। তাই মাদ্রী স্বামীর মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পড়েই দুঃখে প্রান ত্যাগ করেন , এবং দুজনের দেহ একই সাথে দাহ করা হয় । এছাড়াও, মৌষলপর্বে বসুদেবের মৃত্যুর পর তাঁর দেবকী, ভদ্রা, মদিরা ও রোহিণী নামক চার স্ত্রীর সহমৃত্যুতে যাওয়ার কথা উল্লেখ আছে। রাজপুতানায় কোন শহর দখল হবার পূর্বেই বিধবা নারীরা আত্মসম্মান রক্ষার্থে আগুনে ঝাঁপ (বা জহর বা বিষ) দিয়ে স্বেছায় মৃত্যুবরণ করতেন, যা সতীদাহের অনুরূপ।
কিন্তু কালের পরিক্রমায় ৯০০ বছরের এই পুরানো প্রথাটি একটি ভয়ঙ্কর প্রথায় রুপ নেয়। এবং তা ইংরেজদের আমলেও চালু ছিল। তৎ সময়ে যারা পতির মৃত্যুতে সহমৃত্যুতে যেত তাদের বিভিন্ন কারণগুলি হলোঃ
- শোকের যাতনা থেকে নিষ্কৃতি,
- বিধবাজীবনের দুর্দশা থেকে মুক্তি,
- যশোস্পৃহা,
- সামাজিক কর্তব্যতা,
- লোকনিন্দার ভয়,
- অপরের প্ররোচনা,
- উৎপীড়ন ইত্যাদি।
একটা সময় এসে দেখা গেলো, হিন্দু বিধবা স্ত্রীকে সহমৃত্যুতে বাধ্য করা হত। বিশেষ করে কোন ধনী লোকের মৃত্যুর সম্পত্তির অধিকারের লোভে তার আত্মীয়রা সদ্যবিধবা স্ত্রীকে জোরজবরদস্তি করে বেঁধে, ঢাক-ঢোলের শব্দের মাধ্যমে তার কান্নার আওয়াজকে চাপা দিয়ে তার স্বামীর সাথে চিতায় শুইয়ে পুড়িয়ে মারতো।
বেদ, সতীদাহ ও বিধবা বিবাহঃ
পাশ্চাত্যের গবেষকদের অনেকের মাঝে এই প্রথা নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও ভারতীয় বেদ ভাষ্যকারগণদের মতে বেদে সতীদাহ প্রথার কোন উল্লেখ নেই। বরং স্বামীর মৃত্যুর পর পুনরায় বিবাহের ব্যাপারেই তারা মত প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে অথর্ববেদের দুটি মন্ত্র প্রণিধানযোগ্য:
ইয়ং নারী পতি লোকং বৃণানা নিপদ্যত উপত্ব্য মর্ন্ত্য প্রেতম্। ধর্মং পুরাণমনু পালয়ন্তী তস্ম্যৈ প্রজাং দ্রবিণং চেহ ধেহি।[অথর্ববেদ ১৮.৩.১]
অর্থঃ হে মনুষ্য! এই স্ত্রী পুনরায় বিবাহের আকাঙ্ক্ষা করিয়া মৃত পতির পরে তোমার নিকট আসিয়াছে। সে সনাতন ধর্মকে পালন করিয়া যাতে সন্তানাদি এবং সুখভোগ করতে পারে।
উদীষর্ব নার্ষ্যভি জীবলোকং গতাসুমেতমুপশেষ এহি। হস্তাগ্রাভস্য দিধিষোস্তবেদং পত্যুর্জনিত্বমভি সংবভূব। [অথর্ববেদ ১৮.৩.২ এবং ঋগবেদ ১০.১৮.৮]
অর্থঃ হে নারী! মৃত পতির শোকে অচল হয়ে লাভ কি?বাস্তব জীবনে ফিরে এসো। পুনরায় তোমার পাণিগ্রহণকারী পতির সাথে তোমার আবার পত্নীত্ব তৈরী হবে।
তবে বেদে স্পষ্টভাবে সতীদাহের কোন উল্লেখ না থাকলেও সেই সময়ের অবৈদিক সমাজে ক্ষীণভাবে এর প্রচলন ছিল বলে ধারনা করা হয়।
মুসলিম শাসকদের প্রভাব
দিল্লিতে সুলতানি রাজত্বকালে সতীদাহ প্রথার জন্য যাতে বিধবাকে বাধ্য না করা হয় এজন্য পত্নীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সতীদাহ প্রথা আয়োজন করার রীতির প্রচলন করা হয়েছিল। 'মুহম্মদ বিন তুঘলক' প্রথম শাসক যিনি সতীদাহ প্রথাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিলেন। মুঘল সম্রাটরা স্থানীয় প্রচলিত প্রথায় হস্তক্ষেপে সাধারণত প্রচেষ্টায় লিপ্ত হতেন না। কিন্তু তারা এই প্রথা বন্ধের ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। মুঘল সম্রাট হুমায়ুন সর্বপ্রথম সতীদাহের বিরুদ্ধে রাজকীয় হুকুম দেন। এরপর সম্রাট আকবর সতীদাহ আটকানোর জন্য সরকারীভাবে আদেশ জারি করেন। এই মর্মে যে,
- "কোন নারী, প্রধান পুলিশ কর্মকর্তার সুনির্দিষ্ট অনুমতি ছাড়া সতীদাহ প্রথা পালন করতে পারবেন না।"
এছাড়াও এই প্রথা বন্ধের জন্য তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের অধিকার দেন যা। আকবর নিজে জয়মাল নামের একজন মহিলাকে সতীদাহ থেকে বাঁচিয়েছিলেন এবং তার পুত্রকে কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। কারণ সে তার মাকে জোর করে 'দাহ' করতে চেয়েছিল। ফরাসি বণিক এবং ভ্রমণকারী তাভেনিয়ের লেখা থেকে জানা যায় যে, সম্রাট শাহ জাহানের রাজত্বের সময়ে যার শিশু আছে এমন বিধবাদেরকে কোনমতেই পুড়িয়ে মারার জন্য দেওয়া হত না। বাদশাহ আওরংগজেব তাঁর সাম্রাজ্যে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে।
সতীদাহ প্রথা বাতিল
সহমৃত্যুর প্রথা অনেকদিন যাবৎ প্রচলিত থাকলেও বিভিন্ন সময়ে অনেকেই এই প্রথার তীব্র নিন্দা করেছেন। সুলতানি ও মোগল আমলে এই প্রথাকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে। ইংরেজরাও এই বিষয়ে প্রথমে দেশীয়দের সঙ্গে সংঘাতে যেতে রাজী ছিলেন না, তবে বেশ কিছু ম্যাজিস্ট্রেট, বিচারপতি, ধর্মোপাসক ইত্যাদিরা তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদন, পুস্তক ও বিবরণীতে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। ইংরেজীতে প্রকাশিত বেশ কিছু পত্রিকাও এই প্রথার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিল। ১৮১৮ সালের শেষার্ধে রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ এর বিরুদ্ধে সংবাদ ও পুস্তিকা প্রকাশ করলেন এবং পরে তার ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশ করলেন। কলকাতার হিন্দুসমাজের একাংশ ১৮১৯ সালে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল হেস্টিংসকে সতীদাহ প্রথা বাতিল করতে আবেদন করেছিলেন, এবং অনেকে এই প্রথার বিপক্ষে সোচ্চার হয়েছিলেন। ১৮২৯ সালের ৪ই ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীতে সতিদাহ প্রথাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল ঘোষণা করা হয়। এসময় বেঙ্গলের গভর্নর ছিলেন লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক। তবে এই আইনি কার্যক্রম গৃহীত হয় মূলত রাজা রামমোহন রায়ের সামাজিক আন্দোলনের কারনেই। এই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে মামলা করা হয়। তারপর রাজা রামমোহন রায় আদালতে প্রমাণ করে দেন যে সনাতন ধর্মে সতীদাহ বলে কিছু নেই।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন